ম্যাজিক রেডিও (জন চিভার)
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
জন আর আইরিন ওয়েস্টকোট। সুখী দম্পতি। রোজগারপাতি ভালোই। পরিশ্রমী। সমাজে একটা আলাদা সম্মানও আছে। মানে যতটা থাকলে কলেজের প্রাক্তনীদের সমাচারে মাণ্যিগণ্যি হিসাবে নাম তোলা যায় ততটা তো রয়েইছে। দুটি সন্তান তাঁদের। বিয়ে হয়েছে ন বছর। সাটন প্লেসের কাছে এক ফ্ল্যাট বাড়ির বারো তলায় বাস। এমনিতে বেশ শৌখিন মানুষ তারা। বছরে গড়ে ১০.৩ বার থিয়েটারে যাওয়া চাই। একদিন না একদিন ওয়েস্টচেস্টারে একটা বাড়ি বানানোর স্বপ্নও দেখে তারা।
খুব একটা সুন্দরী না হলে কী হবে আইরিন যেমন ভদ্র তেমন মিষ্টি। একমাথা নরম বাদামি চুল। তার ওই চওড়া কপালে অবশ্য তেমন সৌভাগ্যের কথা লেখা নেই। শীতের দিনে কায়দা করে একটা ফারের কোট জড়িয়ে রাখে গায়ে। সেটা আবার মিংকের ফারের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে রঙ করা। জিমকে দেখে তার বয়সের আন্দাজ পাওয়াই যায়…তবে বয়স কাবু করতে পারেনি তার মনকে। মন তার চিরসবুজ। মিলিটারি ছাঁটের চুলে অবশ্য পাক ধরতে শুরু করেছে। অ্যান্ডোভারের মতো অভিজাত শহরে তার গোত্রের লোকজন যে রকম পোশাক আশাক পরে জিমও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনিতে সাদাসিধে মানুষটার আচার ব্যবহারের মধ্যে দারুণ একটা আন্তরিকতা আছে…আবেগ আছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি, ক্লাশমেটদের সঙ্গে একটাই বিষয়ে অমিল তাদের…সেটা হচ্ছে গান বাজনা। তারা দুজনে গান-বাজনার ভক্ত…হালকা গানবাজনা নয়… উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। তারা নিয়মিত কনসার্টে যায়…যদিও সে নিয়ে বিশেষ কারো কাছেই উচ্চবাচ্চ্য করে না। আর সময় পেলেই রেডিওটা চালিয়ে বসে পড়ে। গান বাজনা শোনে।
তাদের রেডিওটা একেবারে আদ্যিকালের। ওটা যেমন অদ্ভূত তেমনি খামখেয়ালি…কখন যে বিগড়োবে আগে থেকে আঁচ পাওয়া মুশকিল। আর বোধহয় সারানো গেল না ওটাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আনাড়ি…রেডিওর কল কবজা কিছুই বোঝে না। চলতে চলতে রেডিওটা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন জিম উঠে রেডিওর মাথায় দুমদাম মারে কয়েক চাঁটি । তাতে কখনো কাজ হয়, কখনো হয় না। সেদিন রবিবার বিকেলে দিব্যি চলছিল শ্যুবার্টের কনসার্ট। বুঁদ হয়ে শুনছিল কত্তা-গিন্নি। হঠাৎই গান গেল থেমে। রেডিও-র মাথায় দুম দুম বাড়ি মেরেও কোনো লাভ হল না সেদিন। রেডিও আর চলল না। কনসার্ট উঠল মাথায়। নাহ এবার একটা নতুন রেডিও না কিনলেই নয়। নতুন রেডিও বাড়িতে আসবেই। বউকে কথা দিয়ে দিল জিম। সোমবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই খুশির খবরটা জানিয়ে দিল বউকে…নতুন রেডিও কেনা হয়ে গেছে। কেমন দেখতে, কত দাম, কী বেত্তান্ত কিছুই ভাঙল না সে…গিন্নিকে নাকি দারুণ একটা চমক দেবে।
পরের দিনে বিকেলে দোকানের লোক এসে জিনিস্টা দিয়ে গেল। ভাগ্যিস সঙ্গে মিস্ত্রি এসেছিল। মিস্ত্রি আর কাজের মেয়েটাকে নিয়ে বাক্স থেকে যন্ত্রটাকে বের করে বসার ঘরে কোনোরকমে নিয়ে গেল আইরিন। ভারি কাঠের ক্যাবিনেটওলা যন্ত্রটা ভারি কিম্ভূত। দেখেই মনটা তেতো হয়ে গেল তার। তার বসার ঘরে এই রেডিও একদম বেমানান। কত যত্ন করে নিজের হাতে বসার ঘরটাকে সে সাজিয়েছে… কত বেছে বেছে এ দোকান ও দোকান ঢুঁড়ে এ ঘরের সব আসবাব…পর্দার কাপড় কিনেছে। এত দেখে শুনে নিজের জামা কাপড়ও বোধহয় সে কেনে না। আর সেই ঘরে কি না জোর করে ঢুকে পড়ল এই ঢাউস বদখত একটা যন্ত্র! উফফ তার এত সাধের জিনিসপত্রের মাঝে ওই বেমক্কা একখানা জিনিস! এ যে চোখে দেখা যায় না! যন্ত্রটা যেমন কুচ্ছিত তেমনি অদ্ভূত তার কল কবজা। কিছুই বোঝা যায় না ছাই। একগাদা সুইচ…ডায়াল…প্যানেল। সব ভালো করে একবার দেখে প্লাগটা গুঁজে যন্ত্রটা চালিয়েই দিল সে। ঝপ ঝপ করে সবুজ আলো জ্বলে উঠল ডায়ালে। তারপর পিয়ানোর ক্ষ্ণীণ আওয়াজ…যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সেই আওয়াজ গাঁক গাঁক করে আছড়ে পড়ল ঘরময়…যেন বিশাল এক শব্দদানব হাঁ করে গিলে নেবে সব…বিকট সেই শব্দের তোড়ে টেবিল থেকে চিনা মাটির বাসন কোসন ঝন ঝন করে পড়ল মাটিতে। ছুটে গিয়ে ভল্যুমটা কমিয়ে দেয় সে । ওই কাঠের বাক্সটার মধ্যে কী যেন একটা অশুভ শক্তি লুকিয়ে রয়েছে। ওটাকে দেখলেই ভারি অস্বস্তি হচ্ছে তার। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরতে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে । তারপর বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে যাওয়া…একটু ঘোরাঘুরি। যন্ত্রটার কথা আর মনেই ছিল না। রেডিওটা আবার চালনোর ফুরসত হল অনেক পর।
সন্ধে বেলা বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়েচান করাতে নিয়ে গেছে আয়া। আইরিনের এখন ছুটি। সে এবার রেডিওটা চালিয়ে বসতে পারে। এবার ভল্যুমটা সে অনেক কম করেই রাখল। কী ভাগ্য…এখন যে ভারি মোৎজার্টেরকনসার্ট দিয়েছে! আইরিন চোখ বন্ধ করে শোনে…সুরের আবেশে ভেসে যায়। খুব ভালো লাগে তার। এখন শব্দটা অনেক স্পষ্ট। কোনো গোলমাল নেই। দেখতে যেমনই হোক পুরোনোটার চেয়েবাবা এটা অনেক ভালো…এটার আওয়াজ অনেজ জোরালো…অনেক খাঁটি। কাঠের বাক্সটাকে নাহয় খুলে সোফার পেছনে রেখে দিলেই হবে। তখন ওটাকে দেখতেও আর অত খারাপ লাগবে না। রেডিও-টাকে এই সবে একটু ভালো লাগতে শুরু করেছিল…অমনি ঝামেলা শুরু। বাজনার মাঝে যেন কতগুলো বাইরের শব্দ। কখনো খট খট আওয়াজ কে যেন দেশলাই কাঠি জ্বালাচ্ছে…পরক্ষণেই শন শন শন শন…সমুদ্রের লোনা হাওয়ার কথা মনে পড়ে আইরিনের। বাজনা যত এগোয় শব্দ তত বাড়ে…হরেক কিসিমের শব্দ। ডায়াল আর সুইচগুলোকে সব টেপাটেপি করে দেখে নেয়। নাহ কোনো কাজ হয় না। যেই কে সেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সে। আর কিচ্ছু সে ভাবতে পারছে না। কিন্তু এত আওয়াজ আসছে কোথা থেকে। খুঁজে তাকে বের করতেই হবে। বসার ঘরের দেওয়ালের ওপারেই লিফটের সুড়ঙ্গ। হ্যাঁ তাইতো…রেডিওতে এতো লিফটেরই ঘর ঘর আওয়াজ। লিফটের কেবলের ক্যাঁচ কোঁচ, দরজা খোলা আর বন্ধ করার আওয়াজ…স…ব ধরা পড়ছে রেডিও-টার লাউড স্পিকারে। তার মানে এই যন্ত্রটার মধ্যে একটা আজব ব্যাপার আছে। আশে পাশের সব বিদ্যুৎ তরঙ্গ টেনে নিতে পারে এই যন্ত্র। এই ভাবতে না ভাবতেই ডোরবেলের টুং টাং, ওয়াশিং মেশিনের ঘটাং ঘটাং, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের একঘেঁয়ে শোঁ শোঁ শুনতে শুনতে তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে সে। কত রকমের যে শব্দ! কলিং বেলের আওয়াজ থেকে শুরু করে লিফটের বেল, ইলেকট্রিক রেজার দিয়ে দাঁড়ি কামানো, মিক্সি মেশিনে মশলা পেষাই…স…ব আওয়াজ এত স্পষ্ট যে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। তার আশে পাশের সব ফ্ল্যাটের এই বিচিত্র সব আওয়াজ এই জঘন্য রেডিওটার লাউডস্পকার ফুঁড়ে বেরোচ্ছে। ধন্যি একখানা যন্ত্র বটে! সেখানে যত গন্ডগোল…হই হল্লা…ক্যাঁচর ম্যাঁচর চুম্বকের মতো সব টেনে আনা চাই। এমন একখানা বিকট যন্ত্রকে বাগে আনা আইরিনের কম্ম নয়। হাল ছেড়ে দেয় সে। রেডিও টা বন্ধ করে বাচ্চাদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
রাতে বাড়ি ফিরে না ফিরেই রেডিওটা নিয়ে পড়ে জিম। যন্ত্রটা চালু করে তারও সেই একই অভিজ্ঞতা। একটা টক শো হচ্ছিল রেডিও স্টেশনে। দূর থেকে বক্তার মৃদু কন্ঠস্বর আচমকাই বিস্ফোরণের মতো কানে আছড়ে পড়ল তার। কানটা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। কেঁপে ওঠে ঘরদোর। ছুটে গিয়ে রেডিও-র আওয়াজ কমিয়ে দেয় সে। তাতেও নিস্তার নেই। দু-এক মিনিট পর থেকেই আবার যত ঝামেলা। আবার সেই হরেক আওয়াজ…টেলফোন, কলিং বেল, লিফটের দরজার ঝাঁকুনি, রান্নার জিনিস পত্রের ঠুকঠাক… মাথার মধ্যে খিচুড়ি পাকিয়ে যায় সব। তবে আইরিনের চেয়ে তার বরের অভিজ্ঞতা অবশ্য একটু আলাদা। শব্দের দাপট বোধহয় আগের থেকে কমেছে। সারাদিনের ধকল বয়ে ক্লান্ত শহরটা ঝিমিয়ে পড়েছে এখন। এত রাতে রেডিও-র লাউড স্পিকারে আর কোনো ইলেকট্রিক রেজারের আওয়াজ নেই…নেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের বিরামহীন শন শন। রাতে সেগুলোর কাজ এখন শেষ। গৃহস্থের দেরাজে সব ঢুকে পড়েছে এখন। রেডিও-র নবগুলোকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে অনেক কসরত করে জিম। কিছুতেই কিছু হয় না। এই শব্দের হাত থেকে কোনো রেহাই নেই। তারা জোর করে ঢুকে পড়বেই। বিরক্ত হয়ে সেও রেডিওটা বন্ধ করেই দেয়। বউয়ের কাছে শুরু হয় তার যত গজ গজ…রেডিওটা গছিয়ে লোকগুলো একদম ঠকিয়ে দিয়েছে…কালই ওদের ডেকে বাপবাপান্ত করে ছাড়তে হবে।
পরের দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে আইরিনের বিকেল গড়িয়ে যায়। দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে একটু খাওয়া দাওয়া ছিল। বাড়ি ফিরতেই আয়া জানিয়ে দেয় দোকান থেকে লোক এসেছিল…রেডিওটা সারিয়ে দিয়ে গেছে। আর তর সয়না আইরিনের। টুপি, কোট না খুলেই সোজা বসার ঘরে গিয়ে আগে রেডিওটা চালিয়ে দেখে। লাউড স্পিকারে ভেসে আসে ভারি চমৎকার এক কনসার্ট…ওহ দারুণ … ‘মিসৌরি ওয়ালটজ’ । মনটা ভালো হয়ে যায় তার। এ তো ঠিক সেই তার ওই পুরোনো টেপ রেকর্ডারটার মতো রিনরিনে ঘসঘসে আওয়াজ। লেকের দিকে ছুটি কাটানোর সময় টেপ রেকর্ডারটা বাজিয়ে প্রায়ই শুনতো সে। কনসার্ট শেষ হয়। আইরিন অপেক্ষা করে যায়…দেখা যায় বাজনাটা নিয়ে ঘোষক কিছু বলে কিনা। কিন্তু ওপারে সব চুপচাপ। সেই ঘসঘসে আওয়াজটা এখনও শোনা যাচ্ছে। দূর ছাই এরা কিছু বলবে না। এবার অন্য স্টেশনে কী হচ্ছে না হচ্ছে একটু শোনা যাক। বাহ স্টেশন ঘোরাতেই এ যে ককেশিয়ান মিউসিক। ধুলোর মধ্যে দিয়ে ধপ ধপ করে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ আর সেইসঙ্গে ধাতব গয়নার ঝনঝনানি। কিন্তু গানের মাঝে আবার সেই ডোরবেল… একগাদা লোকের গলার আওয়াজ…জড়িয়ে যায় সব। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরে। সে রেডিওটা বন্ধ করে বাচ্চাদের ঘরে নিয়ে যায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে জিম ফেরে রাতে। জামাকাপড়টা বদলে তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে রেডিও-টা খুলেছে কি খোলেনি অমনি আয়া এসে খাওয়ার তাড়া দিয়ে যায়।
সারা শরীরে ক্লান্তি। খেতে বসে জিম অত ভদ্রতা তদ্রটার ধার ধারে না। ডিনারের খাবার দাবার নিয়ে আইরিনের কোনো আগ্রহ নেই। খেতে হয় তাই খাওয়া। রুপোর মোমাদানির দিকে চেয়ে চেয়ে তার মন এবার চলে যায় আবার রেডি-ও টার দিকে। হালকা গান ভেসে আসছে যন্ত্রটা থেকে… শোঁপার প্রেলিউড। খুব মন দিয়ে সে শোনে। হঠাৎ রসভঙ্গ। গানের আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে এক পুরুষ কণ্ঠ …’ ওহ দোহাই তোমাকে ক্যাথি, যখনই আমি বাড়িতে ঢুকব তখনই কি তোমায় পিয়ানোটা নিয়ে প্যান প্যান করতে হবে?। গান থেমে যায়। আইরিনের চোখ কপালে। এরপর মহিলার গলা… ‘সারাদিন তো অফিসেই থাকি। আর কখন সময় পাব বলো?’ তারপর আবার সেই পুরুষটির কথা…’সে তো আমিও থাকি’। লোকটা এবার পিয়ানোটাকে নিয়ে নোংরা একটা কথা বলে ধড়াস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার শুরু হয় গান। বিষণ্ণ মুর্চ্ছনা মীড় তুলে যায়।
আর নিজেকে সামলাতে পারে না আইরিন… ‘কী গো শুনতে পেলে?’
তখনো ডেসার্টটা খেতেইব্যস্ত জিম…’ কী বল তো?’
‘ আরে রেডিওটার কথা বলছি…ঐ গানটার মাঝে একটা লোক কেমন অসভ্য কথা বলল শুনলে না?’
‘ কোনো নাটক টাটক হবে হয়তো’।
‘না না। আমার তো মনে হয় না’।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে কফিটা নিয়ে দুজনেই বসার ঘরে চলে আসে। রেডিও-তে অন্য আরেকটা স্টেশন চালানোর জন্য জিমকে বলে আইরিন। সেই মতো নবটা ঘোরায় জিম। কিন্তু আবার কার আওয়াজ? কোথা থেকে আবার এক পুরুষ কণ্ঠ… ‘ আমার রাবার ব্যান্ডদুটো দেখেছ?’ ‘ আমার রাবার ব্যান্ড? দেখেছ কী?’ পুরুষটির গলায় একরাশ বিরক্তি। এর পর আবার এক মহিলার গলা… ‘ আমার বোতাম কটা লাগিয়ে দাও… আমি খুঁজে দিচ্ছি তোমার রবার ব্যান্ড’। সঙ্গে সঙ্গে অন্য স্টেশনে নবটা ঘুরিয়ে দেয় জিম…সেখানেও আবার এক পুরুষের গলা… ‘আমার অ্যাশ ট্রে-তে আবার যেন আপেলের ছিবড়ে ফেলতে এসো না…ওই গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না’।
‘ এ তো ভুতূড়ে ব্যাপার স্যাপার’!
‘হ্যাঁ তাই তো বটে’।
নবটা আবার ঘোরায় জিম। এবার এক মহিলা ইংরেজদের কেতায় সুর করে ছড়াশুনিয়ে যায় … ‘On the coast of Coromondel where the pumpkins blow/ In the middle of the woods lived the Yonghy-Bonghy-Bo: Two old chairs, and half a candle, one old jug without a handle…’
চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে ওঠে আইরিন… ‘আরে! আ যে সুইনিদের বাড়ির আয়া’।
ওদিকে মহিলা তখনো সুর করে ছড়া আওড়ে যায়… ‘ These were all his wordly goods’.
‘বন্ধ করো, রেডিওটা এক্ষুণি বন্ধ করে দাও বলছি…ওরাও আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে’।
রেডিও-টা বন্ধ করে দেয় জিম।
আইরিনের ঘোর তখনো কাটেনি… ‘ উনি সুইনিদের আয়া। মিস আর্মস্ট্রং। ওদের বাড়ির বাচ্চাটাকে বোধহয় উনি ছড়া শোনাচ্ছিলেন। ওরা ১৭-বি ফ্ল্যাটে থাকে। পার্কে মিস আর্মস্ট্রং-এর সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি ওঁর গলা খুব ভালো করে চিনি। হে ভগবান! তারমানে অন্যদের বাড়ির হাঁড়ির খবর সব আমরা শুনতে পাচ্ছি।
‘ না না, তা কী করে সম্ভব’…জিমের গলায় এখনও অবিশ্বাস।
ধৈর্য হারায় আইরিন। সে আর বুঝিয়ে উঠতে পারছে না… ‘ আমি জানি উনিই সুইনিদের আয়া। আমি ওঁর গলা চিনি। আর ওঁকেও খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু ওরা আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না তো? শুধু এটাই ভাবছি আমি’।
সুইচটাকে একটু নাড়াচাড়া করে জিম। এবারও সেই একই কাণ্ড…দূর থেকে কাছে… আরো কাছে যেন বাতাসে ভেসে আসে সেই একই গলা। সুইনিদের আয়া আবার সুর করে পড়ে যায় তার ছড়া…পুরো ইংরেজদের কায়দায় ‘Lady, Jingly, Lady Jingly…Sitting where the pumpkins blow, Will you be my wife, said the Yonghy-Bonghy- Bo…’
জিম রেডিও-র লাউডস্পিকারে মুখ লাগিয়ে বলে ‘হ্যালো’। কোনো উত্তর নেই ওপাশ থেকে। সুইনিদের আয়া পড়েই চলে… ‘I am tired of living singly/ On this coast so wild and shingly/ I’m a-weary of my life/ if you’ll come and be my wife, quite serene be my life…’
‘নাহ ওরা বোধহয় কিছু শুনতে পাচ্ছে না। দাঁড়াও অন্য একটা স্টেশন দেখি’।
নবটা ঘুরিয়ে অন্য স্টেশনে দেয় জিম। এখানে যে খুব হইচই। বোধহয় ককটেল পার্টি চলছে কোথাও। কাচের গেলাসের টুং টাং…পিয়ানোর আওয়াজ…কে যেন একটা হেঁড়ে গলায় গানও গাইছে। কত লোকের উল্লাস…খুশিতে উপচে পড়া কথাবার্তা রেডিও-র লাউড স্পিকার বেয়ে জিন-আইরিনের বসার ঘরে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ে সব।… ‘আরেকটা স্যান্ডুইচ নিন না…’ বলেই হেসে গড়িয়ে পড়েন মহিলা। বুদিবুদিয়ে ওঠে হাসির ফোয়ারা। তার মাঝেই খাবারসুদ্ধ এক প্লেট ঝন ঝন করে পড়ে মাটিতে।
এবারও আইরিনের চোখ ছানাবড়া… ‘ এ তো ফুলারদের ফ্ল্যাট। ১১ ই। আমি তো জানি ওদের বাড়িয়ে আজ সন্ধ্যেতে পার্টি আছে। মিসেস ফুলারকে আজ সকালেই মদের দোকানে দেখেছি। এ কীসব ম্যাজিক হয়ে যাচ্ছে বলো তো দেখি! এবার অন্য কোনো স্টেশনে দাও তো দেখি…দেখি তো ১৮ সি ফ্ল্যাটের কিছু খবর পাওয়া যায় কি না!’
আরো কতকিছু শোনা যায় রেডিওতে। কানাডায় কে একজন স্যামন মাছ ধরে এসেছেন তার দীর্ঘ বিবরণ…তাসের আড্ডার খুচরো গল্প… সি আইল্যান্ডে পনেরো দিন কাটানোর গল্প শোনা যায় কোনো এক বাড়িতে… তারপর স্বামী-স্ত্রীর হুলুস্থুল ঝগড়া। ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে ফেলেছে বউ। তাই নিয়ে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়। লোকের বাড়ির সব কিসসা শুনে মাঝেরাতে রেডিওটা বন্ধ করে শুতে যায় তারা। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল একদম। আরো রাতের দিকে জল খাওয়ার জন্য চেঁচায় ছেলে। আইরিন উঠে ছেলেকে জল দিতে যায়। আর ঘুম আসে না তার চোখে। রাত কত হল কে জানে? রাস্তার আলোগুলো নিভে গেছে সব। চারদিক নিঝুম…নিস্তব্ধ। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না তার। উশখুশ করতে করতে বসার ঘরে এসে আবার রেডিওটা চালিয়ে দেয় সে। ওপারে ঘড় ঘড় কাশির আওয়াজ… কারো যেন একটা আর্তনাদ। তারপর এক পুরুষকণ্ঠের আওয়াজ… ‘ তুমি ঠিক আছ তো সোনা?’ উত্তরে মহিলা বলেন ‘হ্যাঁ’…তার গলাটা ভারি বিষণ্ণ…ক্লান্ত… ‘হ্যাঁ গো আমি ঠিকই আছি’। আবেগে উথলে ওঠেন মহিলা… ‘জানো চার্লি আমি মনে হয় আর নিজের মধ্যে নেই। হপ্তায় মিনিট পনেরো কুড়ি হবে যখন আমি নিজের মতো থাকি। কিন্তু আর কোনো ডাক্তারের কাছে আমি যাব না চার্লি। এত খরচ হয়ে গেছে এর মধ্যে। চার্লি সত্যি বলছি আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না…কেমন যেন হারিয়ে ফেলি নিজেকে’। এ নিশ্চয়ই মধ্যবয়সি কোনো দম্পতির সংলাপ। গলার স্বর শুনেই ঠিক বুঝতে পারে আইরিন। নিঃসঙ্গ এই মানুষদুটোর যন্ত্রণা…তার ওপর জানালা দিয়ে বাইরের শিরশিরে হাওয়া শরীরে কাঁপণ ধরিয়ে দেয় তার। আবার বিছানায় সেঁধোয় সে।
পরের দিন সকালের জলখাবারটা সে নিজের হাতেই বানায় । রান্নার মাসি এখনো এসে পৌঁছয়নি। এই তো একতলাতেই থাকে। তাও সময় মতো আসতে পারে না। নিজেই সে মেয়ের চুল বেঁধে দেয়। স্বামী, ছেলে-মেয়েরা লিফটে ওঠে। ওরা নীচে না নামা অবধি সে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই থাকে। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তার অখণ্ড অবসর। বসার ঘরে এসে এবার সে রেডিওটা চালায়। এবার এক বাচ্চার চিল চিৎকার ‘ আমি স্কুলে যাব না, যাব না। ভালো লাগে না আমার স্কুলে যেতে। আমি কিছুতেই যাব না’।
সঙ্গে সঙ্গে রেগে মেগে চেঁচিয়ে ওঠেন ওপারের মহিলা… ‘যাব না বললেই হল। এমনি এমনি তোমাকে ওই স্কুলে দেওয়ার জন্য আটশো ডলার গচ্চা দিয়েছি? মরে গেলেও যেতে হবে তোমাকে’। রেডিও-তে আবার ভেসে ওঠে শতবার বাজানো সেই রেকর্ড…রিনরিনে মিসৌরি ওয়ালটজ। রেডিওটা চালিয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ির সকালের খাওয়ার টেবিলের একান্ত আলাপচারিতা শুনে ফেলে সে…বদহজম নিয়ে খিটখিট…শরীর দেওয়া নেওয়ার রোমহর্ষক গল্প…কারো আকাশছোঁয়া অহংকার, কারো বা বিশ্বাস আর হতাশার কাহিনী… সব কানে আসে তার। শুনতে শুনতে ভারি মুষড়ে পড়ে সে। জীবনের এই অন্ধকার দিকটাকে তো সে আগে দেখেইনি। নিপাট সরল ছন্দেই কেটে গেছে তার জীবন…কোনো ঝড়ঝাপটাও আসেনি। রেডিওটার লাউডস্পিকারে এই কর্কশ…হিংস্র কথাবার্তা আর সহ্য হচ্ছে না তার। থেকে থেকেই গা-টা গুলিয়ে উঠছে। মাথাটা ভার। তাও তাকে সব শুনে যেতে হবে। কোন নিশিতে যে পেয়েছে তাকে! আয়া আসা অবধি একটানা সে শুনেই যায় নানা লোকের কেচ্ছা কাহিনি। তারপর আয়াকে দেখামাত্রই চট করে গিয়ে সুইচটা বন্ধ করে দেয়। সে যে এতক্ষণ চুরি করে অন্য লোকের কথা শুনছিল খেয়াল হয় তার। এক বন্ধুর সঙ্গে দুপুরের খাবারটা আজ বাইরেই খাবে সে। বারোটার একটু পরেই তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তার ফ্ল্যাটের কাছে লিফট এসে থামে। লিফটের ভেতরে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন মহিলা রয়েছেন। সে হাঁ করে চেয়ে থাকে তাঁদের দিকে। তাঁদের ফারের কোট, ফুলকাটা দামি পোশাক, মাথার টুপি আর ভাবলেশহীন মুখ দেখে আলাদা করে কিছু বোঝার উপায় তো নেই। কিন্তু এদের মধ্যে কে যে সি আইল্যান্ডে ছুটি কাটিয়ে এসেছে আর কে ই বা ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে নিয়েছে মনে মনে বোঝার চেষ্টা করে আইরিন। এর মাঝেই এগারো তলায় এসে থামে লিফট। দুটো কুকুর নিয়ে এক মহিলা এসে ওঠেন। চুলটা তাঁর চুড়ো করে বাঁধা। গলায় কায়দা করে মিংকের ফারের শাল জড়ানো। মিসৌরি ওয়ালটজ-এর সুর গুণগুণ করে যান তিনি।
লাঞ্চে মাত্র দুটো মার্টিনি নেয় আইরিন। তার দুটো কৌতূহলী চোখ শুধু ঘুরে বেড়ায় বান্ধবীর চোখে মুখে…ওই চোখেও কি কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রয়েছে? খাওয়ার পরে একটু কেনাকাটা করার করার কথাও ছিল তাদের। কিন্তু এখন আর ওসবে মন নেই আইরিনের। তার মন পড়ে রয়েছে তার বসার ঘরে…রেডিওটার দিকে। কোনো রকমে একটা বাহানা করে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে আসে সে। আয়াকে বলে দেয় এখন যেন তাকে মোটেই বিরক্ত না করা হয়। একছুটে বসার ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। অলস বিকেলের টুকরো টাকরা কিছু কথা ভেসে আসে রেডিও-তে। ভুলিয়ে ভালিয়ে পিসির মেজাজ ঠাণ্ডা করছে এক মহিলা…কারো বাড়িতে লাঞ্চ পার্টি এই শেষ হল…এখনও তার রেশ কাটেনি। ককটেলের অতিথিদের সামলানোর ব্যাপারে বাড়ির পরিচারিকাকে অতি মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন গৃহকর্ত্রী… ‘ শোন যাদের মাথার চুল সাদা একমাত্র তাদেরই দামি স্কচটা দেবে…আর কাউকে না। বুঝলে?’ … ‘ ও আর হ্যাঁ মেটের চচ্চড়িটা শেষ করার পর তবে ভালো খাবার দাবারগুলো বের করবে। ওহ আমাকে পাঁচ ডলার ধার দিতে পারবে…লিফটম্যানকে একটু টিপস দিতে হবে’।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। লাউডস্পিকারে মানুষের কলরব বাড়ে। বসার ঘরের চেয়ারটা থেকেই ইস্ট নদীর ওপরে আকাশটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আইরিন। আকাশের গায়ে থোকা থোকা সাদা মেঘ…যেন সমুদ্রের দখিনা বাতাস শীতের কুয়াশাকে ছিঁড়ে খুড়ে উত্তরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লাউডস্পিকারে ককটেল পার্টির অতিথিদের হই হল্লায় চটক ভাঙে তার। হ্যাঁ হ্যাঁ ওই তো অতিথিরা সব এসে গেছে…ঐ কোন বাড়িতে বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরল…বাড়ির কর্তারা ফিরল অফিস থেকে। এর মাঝে আবার এক মহিলার গলা… ‘জানো তো আজ সকালে বাথরুমে একটা বড় হিরে কুড়িয়ে পেয়েছি, কাল নির্ঘাৎ ওটা মিসেস ডান্সটনের ব্রেসলেট থেকে খুলে পড়ে গেছে’।
‘ঠিক আছে রেখে দাও। আমরা ওটা বেচে দেব’। নিশ্চয়ই মহিলার স্বামীর গলা… ‘ ম্যাডিসন অ্যাভিনিউতে কোনো ভালো গয়নার দোকানে নিয়ে ওটাকে বেচে দাও। মিসেস ডান্সটন বুঝতেও পারবেন না। এমন হিরে ওঁর অনেক আছে। আমাদের বেশ ভালো একটা কামাই হয়ে যাবে কী বলো?’
সুইনিদের আয়ার গলাও পায় আইরিন। এখনো সে সুর করে ছড়াই বলে যাচ্ছে… ‘ Oranges and lemons, say the bells of Clements/ half pence and farthing, say the bells of St Martin’s/ When will you pay me? Say the bells at Old Bailey…’
‘আরে না না ওটা কোনো টুপির গল্প নয়…ওটা ওদের প্রেমের গল্প। হ্যাঁ হ্যাঁ…’ চিৎকার করে ওঠেন এক মহিলা… ‘আমাকে ওয়াল্টার ফ্লোরেল তাই বল্লেন…ওসব টুপি ফুপি আসলে ওদের দেখা করার বাহানা’। ভদ্রমহিলাই আবার গলাটা খাদে নামিয়ে কাউকে যেন একটা বলেন… ‘ তুমি কারো সঙ্গে কথা বলছ না কেন? কথা বল। ওই খিটকেল মহিলা যদি তোমায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে আমাদের পার্টি থেকে বের করে দেবে। তুমি তো জানো এইসব পার্টিতে আসতে আমি কত ভালোবাসি’।
ডিনারে সেদিন বাইরে যাওয়ার কথা। জিম বাড়ি ফিরে দেখে বউয়ের সাজগোজ শেষ হয়নি। আইরিনকে বড় শুকনো আর ছাড়া ছাড়া লাগে তার। একটু পানীয় নিলে হয়তো মনটা একটু ভালো হবে।এই ভেবে নিজেই ককটেলটা বানিয়ে আনে। বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। হেঁটেই রওনা দেয় তারা। তারাভরা আকাশটা আজ বড় মায়াবি। বসন্তের এই সুন্দর সন্ধেগুলোতেই তো মানুষের ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উড়তে চায়। পুরোনো স্মৃতিরা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। নরম বাতাস তাদের মুখ চোখ হাত ছুঁয়ে যায়। রাস্তার মোড়ে ‘সালভেশন আর্মি’র ব্যান্ড গান গাইছে ‘ জেসাস ইজ সুইটার’। স্বামীর হাতটা ধরে টেনে থামায় আইরিন। গানটা সে ভালো করে শুনতে চায়… ‘ এরা কী ভালো তাই না? আমরা চারপাশে যাদের দেখি তাদের চেয়ে এরা ঢের ভালো’। এই বলে নিজের পার্স থেকে একটা নোট বের করে ওদের কাছে গিয়ে দিয়ে দেয়। তার মুখে যেন কীসের যন্ত্রণা। জিম ঠিক ঠাহর করতে পারে না। ডিনার পার্টিতেই তার হাবভাব কেমন যেন খাপছাড়া ঠেকে। অন্যের কথার মাঝে সে বার বার কথা বলে ওঠে। সবার দিকে কেমন যেন কটমট করে চেয়ে থাকে। বাচ্চারা যদি এটা করত। এই আইরিনই তখন তাদের বকে ঝকে একসা করত।
পার্টি শেহ হওয়ার পর হেঁটেই বাড়ির পথ ধরে তারা। এখনো রাত তেমন হয়নি। বসন্তের রাতে একঝুড়ি তারার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকে আইরিন… ‘ কত দূর থেকে ওই তারাগুলো আলো ছড়াচ্ছে তাই না? এই পাঁকে ভরা দুনিয়ায় মানুষের ভালো কাজগুলোই শুধু ওই তারাদের মতো আলো হয়ে থাকে। বাকি তো সবই অন্ধকার’। বাড়ি ফিরে জিম ঘুমিয়ে পড়ে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন ছিল আইরিনএতক্ষণ। সে বসার ঘরে গিয়ে রেডিওটাকে নিয়ে পড়ে।
পরের দিন জিমের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে ছটা। এমা মানে আয়া তাকে দরজা খুলে দেয়। টুপিটা নামিয়ে রেখে সবে সে কোটটা খুলতে যাবে অমনি পাগলের হলঘরে ছুটে আসে আইরিন। চুল তার আলুথালু…মুখ চোখ টকটকে লাল… ‘এক্ষুনি ১৬ সি ফ্ল্যাটে যাও জিম। না না কোটটা আর খুলতে হবে না। তাড়াতাড়ি ১৬ সি-তে যাও। আর দেরি কোরো না। দোহাই তোমার। মি. অসবর্ন তার বউকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সেই চারটে থেকে ওরা ঝগড়া করছে। এখন আবার এই মারপিট। যাও গিয়ে ওদের থামাও’।
বসার ঘরে রেডিও থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, নোংরা গালাগালি, চড়-চাপ্পড়ের আওয়াজ স…ব শুনতে পায় জিম… ‘তোমার এসব শোনা মোটেই উচিত হয়নি আইরিন।…খুব বাজে অভ্যেস’। এক দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে রেডিওটা সে বন্ধ করে দেয়… ‘লোকের কথা আড়ি পেতে শোনা এ সব কী হচ্ছেটা কী আইরিন? তোমার কি এগুলো শোনা উচিত? তুমি রেডিওটা বন্ধ করে দিলেই পারতে’।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আইরিন… ‘উফফ কী সাঙ্ঘাতিক…কী ভয়ংকর! আর ভাবতে পারছি না আমি। আমি সারাদিন এসব শুনি। আমার মনটা ভেঙে চূরমার হয়ে যায়’।
‘ তোমার যদি এতই মন খারাপ হয় তাহলে এসব ছাইপাঁশ শোনো কেন? তুমি যাতে একটু আনন্দ পাও সেজন্যই এই রেডিওটা কেনা। অনেক টাকা ঢেলেছি এর পেছনে। ভেবেছিলাম তুমি অন্তত একটু আনন্দ পাবে। তোমার মুখে হাসি দেখতে চেয়েছি আমি’।
‘ আর না জিম। আমার সঙ্গে আর ঝগড়া কোরো না’। গলাটা কেমন যেন আর্তনাদের মতো শোনায় তার। মাথাটা সে এলিয়ে দেয় স্বামীর কাঁধের ওপর… ‘সবাই খালি সারাদিন ঝগড়াই করে যাচ্ছে। সব্বাই। সবাই শুধু টাকা টাকা করেই গেল। মিসেস হাচিনসনের মা ফ্লোরিডায় একা একা ক্যান্সারে ধুঁকছে। শুধু টাকার জন্য মায়ো ক্লিনিকে ওঁর চিকিৎসা হচ্ছে না। মি. হাচিনসন তো বলেই দিয়েছেন ওঁর হাতে টাকা নেই। আর এই ফ্ল্যাটবাড়ির কোন এক মহিলা ওই জঘন্য মিস্ত্রিটার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। ভাবতে পারো? ছিঃ! ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে। মিসেস মেলভিলের আবার হার্টের ব্যামো। এই এপ্রিলেই মি.হেনড্রিক্সের চাকরিটা চলে যাবে। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন মিসেস হেনড্রিক্স। আর ওই যে মেয়েটা মিসৌরি ওয়ালটজ গুনগুনিয়ে যায় সে একটা বেশ্যা…এক্কেবারে বাজারের মেয়ে। আমাদের লিফটম্যান টিউবারকুলোসিসে ভুগছে। আর মি.অসবর্ন তার বউকে ধরে পেটাচ্ছে। উফফ আর পারছি না আমি’…এই বলে কঁকিয়ে ওঠে সে। এক প্রবল যন্ত্রণায় সারা শরীর বেঁকেচূরে যায় তার। চোখের জল সামলাতে দু হাতে মুখটা চেপে ধরে সে।
‘ কেন এসব শোনো তুমি?…এতই যদি কষ্ট পাও তাহলে কেন শোনো এসব?’ চেঁচিয়ে ওঠে জিম। সে জবাবদিহি চায়’।
‘না না না। ওভাবে আর বোলো না। জীবনটা যে এত কষ্টের, এত যন্ত্রণার…এত নিষ্ঠুর আগে যে বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাদের কক্ষনো এমনটা হয়নি তাই না? কী বল? আমরা তো সবসময় একে অপরকে সম্মান করেছি, ভালোবেসেছি…তাই না? আমাদের দুটো সন্তান রয়েছে…মিষ্টি…ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। আমাদের জীবনে কোনো কষ্ট নেই তাই না সোনা? কী গো নেই তো? বলো না?’ স্বামীর গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে মুখটা আরো কাছে টেনে আনে সে… ‘আমরা তো সুখী কী গো বলো না? আমারা খুব সুখী তাই না?’
‘ হ্যাঁ তাই তো। আমরা খুব সুখী’। বউকে শান্ত করতে মুখ খুলতেই হয় জিমকে। কিন্তু মনের বিরক্তিটাকে আর চেপে রাখতে পারে না সে… ‘ হয় এই হতচ্ছাড়া রেডিওটাকে সারাবো নয় কালকেই ওটাকে বিদেয় করব’। বউয়ের চুলে বিলি কেটে দেয় সে… ‘ আমার লক্ষ্মী সোনা’।
‘তুমি তো আমাকে ভালবাসো তাই না? আমাদের মধ্যে কোনো ভণ্ডামি নেই। আমরা লোকের মতো অমন সারাক্ষণ টাকা টাকা করেও বেড়াই না। আমাদের মধ্যে কোনো লুকোছাপা নেই বাবা। কী তাই তো সোনা?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ একদম তাই সোনা’।
পরের দিন সকালেই দোকান থেকে মিস্ত্রি এসে রেডিওটা সারিয়ে দেয়। খুব সাবধানে রেডিওটা খোলে আইরিন। নাহ জিনিসটা বোধহয় এবার ঠিক হয়েছে…ক্যালিফোর্নিয়া ওয়াইনের বিজ্ঞাপণের পর বিথোফেনের নাইন্থ সিমফনি শুনে মনটা নেচে ওঠে তার। তার ওপর উপরি পাওনা সিলারের ‘ওড টু জয়’। রেডিও চলে সারাদিন। আর কোনো গণ্ডগোল নেই। উফফ এবার তাহলে শান্তি।
জিম যখন বাড়ি ফেরে তখন একটা স্প্যানিশ মিউজিক বাজছিল। ‘ কী সব ঠিক আছে তো?’ বউয়ের কাছ থেকে সব খোঁজ খবর নেয় জিম। কিন্তু আজ জিমের মুখটা অত ফ্যাকাশে লাগছে কেন ? চিন্তায় পড়ে আইরিন। নিজেদের জন্য গেলাসে একটু ককটেল নিয়ে ডিনারের জন্য ‘অ্যানভিল কোরাসে’ ঢুঁ মারে তারা। সেখান থেকে দেবুসির ‘লা মের’। একের পর এক রেস্তোরাঁয় ঘুরে বেড়ায় তারা।
‘ রেডিওটার টাকা আজ দিয়ে দিয়েছি। চারশো ডলার। আশা করি এবার তোমার মনটা একটু ভালো থাকবে’।
‘ হ্যাঁ নিশ্চয়ই থাকবে’।
‘ দেখো চারশো ডলার কোনো মুখের কথা নয়। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে আমাকে। তোমার খুশির জন্য এটুকু আমি করেছি। এ বছর আর কোনো বিলাসিতা নয়। আচ্ছা তুমি ধোপার টাকা মেটাওনি কেন এখনো? তোমার ড্রেসিং টেবিলে বিলগুলো দেখলাম। তাহলে আমায় কেন বলেছিলে যে সব মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে? কেন মিথ্যে বলেছ আমায়?’
‘ দেখো এইসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি’। গলা শুকিয়ে যায় আইরিনের। ঢোঁক ঢোঁক জল খায় সে… ‘না মানে আমি ভেবেছিলাম এমাসের হাতখরচের টাকা থেকে ওটা আমি মিটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু গত মাসে ওই কুশন কভার কিনতে হল…তারপর পার্টির খরচ…
‘ শোনো…আমি যে টাকাটা তোমায় দিই সেটা আরো বুদ্ধি করে খরচ করতে হবে তোমায়।জানোই তো গত বছরের মতো এবার অত টাকা নেই এবার হাতে। টানাটানির মধ্যে রয়েছি। মাইকেলের সঙ্গে আজই আমার কথা হয়েছে। ঠিক মতো চলছে না কিছুই। কেউ কোনো জিনিস কিনছে না। তার ওপর কোম্পানির অবস্থাও ভালো নয়। নতুন নতুন জিনিস বানাতে আমারা কত সময় দিই। সেগুলোই যদি বাজারে না চলে! বয়সটাও আর বসে নেই। এই তো সাঁইত্রিশ হয়েই গেল। এরপর চুলে পাক ধরবে। কেরিয়ারে আমার যতটা উন্নতি করার কথা ছিল ততটা তো করে উঠতে পারি্নি। এখন আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই। আমাদের অবস্থা আর ফিরবে বলে তো মনে হয় না’।
‘হ্যাঁ তাই তো’।
‘খরচ কমাও…যেখানে পারো খরচ কমাও। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে। শোনো তোমাকে খোলাখুলি একটা কথা বলতে চাই…এই টাকা পয়সার চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না আমার। কাল কী হবে না হবে কেউ জানে না। আমার যদি কিছু ভালোমন্দ হয়ে যায়? বিমা একটা আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে আর কতদিন! তোমাকে…বাচ্চাদের একটু আরামে রাখার জন্য নিজের সবটা দিয়ে দিয়েছি আমি। কিন্তু জানো তো আমার রক্ত জল করা পরিশ্রম তোমার ওই ফার কোট, রেডিও আর কুশন কভার আর লোক দেখানো ঠাটবাটেরপেছনেই নষ্ট হবে এটা কিছুতেই মানতে পারি না’।
‘চুপ করো জিম…দোহাই তোমার…ওরা আমাদের শুনে ফেলবে’।
‘ কে? কে শুনবে? এখান থেকে এমা আমাদের কথা শুনতে পাবে না’।
‘ না না, ওই রেডিও’।
‘ উফফফ আমি আর পারছি না বিশ্বাস করো’…রাগে চেঁচিয়ে ওঠে জিম… ‘তোমার এই বাতিকের জ্বালায় পাগল হয়ে যাই আমি। রেডিও আমাদের কথা শুনতে পাবে না। কেউ শুনতে পাবে না। আর শুনলেই বা কী যায় আসে…আমি থোড়াই কেয়ার করি!’
আস্তে আস্তে উঠে বসার ঘরে চলে যায় আইরিন। জিমও যায় তার পিছু পিছু। মাথায় আজ ভূত চেপেছে তার। সব বিষ সে উগরেই ছাড়বে… ‘ এত সতী সাবিত্রী কবে থেকে হলে তুমি? এত কিছু কাণ্ডের পর রাতারাতি ধোয়া তুলসী পাতা সাজা হচ্ছে? ন্যাকামি! তোমার মায়ের উইল প্রবেট নেওয়ার আগেই তুমি তাঁর গয়না চুরি করনি? নিজের বোনকেও এক কানাকড়ি দাওনি তুমি। তাকে তুমি ঠকিয়েছ। তার প্রাপ্য টাকা থেকে তাকে বঞ্চিত করেছ। তার নিতান্ত দুর্দশার সময়েও এক পয়সা ঠেকাওনি তাকে। গ্রেস হাওল্যান্ডের জীবনটাকে বরবাদ করে দিয়েছ তুমি। আর যেদিন নাচতে নাচতে ওই হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে পেট খসাতে চলে গেলে সেদিন কোথায় ছিল তোমার এত নীতি…বড় বড় সব বুলি? সেদিন তোমার মধ্যে কোনো তাপ উত্তাপ ছিল না কি? দিব্যি সেজে গুজে ব্যাগপত্র নিয়ে চললে যেন পিকনিকে যাচ্ছ। গিয়ে বাচ্চাটাকে নিকেশ করে এলে। এর কোনো কারণ দেখাতে পারবে তুমি? কোনো একটা জুতসই কারণ?’
কিম্ভূত রেডিওটার পাশে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আইরিন। মুখে তার কোনো কথা যোগায় না। লজ্জায়, অপমানে মাটিতে মিশে যায় সে। কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। এখন এই রেডিওটা শুনলেই হয়তো তার প্রাণটা একটু জুড়বে। সুইনিদের আয়ার ছড়া শুনতে খুব ইচ্ছে করছে তার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিম চেঁচিয়ে চলেছে। আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত এত তাড়াতাড়ি বন্ধ হওয়ার নয়। রেডিওর লাউডস্পিকারেনিরুত্তাপ রুটিন ঘোষণা… ‘ আজ সকালে টোকিয়ো-তে রেল দুর্ঘটনায় ২৯ জন মৃত। বাফেলোর কাছে অন্ধ শিশুদের হাসপাতালে ভয়াবহ আগুন। নানদের চেষ্টায় আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে। আজকের তাপমাত্রা সাতচল্লিশ। আপেক্ষিক আর্দ্রতা উননব্বই’।
- ম্যাজিক রেডিও গল্পটি জন চিভারের ‘ইনরমাস রেডিও’ গল্পটির অনুবাদ।